আসসালামু আলাইকুম
এই পোস্টটি পড়ে আপনারা যা জানতে পারবেন-
- জন্ডিস কি,
- জন্ডিস কেন হয়,
- জন্ডিস কি আসলেই কোন রোগ ,
- নবজাতকের জন্ডিস,
- জন্ডিসের চিকিৎসা,
জন্ডিস
জন্ডিস আমাদের কাছে একটি বহু পরিচিত শব্দ। এই শব্দটি কারণে-অকারণে ব্যবহার করে থাকি এবং না বুঝে এই বিষয়টি নিয়ে আমরা অনেকেই ভীতিকর অবস্থায় পড়ি। কিন্তু, আপনি শুনে অবাক হবেন যে জন্ডিস কোন রোগই নয় বরং এটি অন্য রোগের উপসর্গ মাত্র।
জন্ডিস হওয়ার কারণ
আমাদের রক্তে বিলোরুবিনের মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেড়ে যায় তখন আমরা তাকে জন্ডিস বলি। আমাদের রক্তের লোহিত রক্তকণিকা গুলো একটা সময়ে স্বাভাবিক নিয়মে ভেঙে গিয়ে বিলোরুবিনে রূপান্তরিত হয় যা পরবর্তীতে লিভারে প্রক্রিয়াজাত হয়ে পিত্ত রসে সাথে পিত্তনালীর মধ্য দিয়ে পরিপাকতন্ত্রে প্রবেশ করে এবং সেখান থেকে মলের সাথে শরীর থেকে বেরিয়ে যায়। বিলোরুবিনের এই দীর্ঘ পথ-পরিক্রমায় রক্তে বিলোরুবিনের মাত্রা বেড়ে গিয়ে দেখা দেয় জন্ডিস। এই রোগে চামড়া পান্ডু ফ্যাকাসে দেখায় বলে একে পান্ডু রোগও বলা হয়ে থাকে।
জন্ডিস কোন রোগ কি না কে
জন্ডিস রোগ না হওয়ার কারণ হল এটি অন্য রোগ হওয়ার লক্ষণ বা উপসর্গ মাত্র। মনে করুন, কোন রোগের পিত্ত চলাচলের নালীতে পাথর আটকে গেল এর ফলে পিত্ত আর অন্ত্রের মধ্যে প্রবেশ না করায় এটি রক্তের সাথে মিশে রক্তের বর্ণ হলুদ হওয়া শুরু করলে এটা কে আমরা বলছি জন্ডিস।
জন্ডিসের চিকিৎসা
জন্ডিসের চিকিৎসা নয় চিকিৎসা করতে হবে পিত্তথলির। পিত্তথলির পাথর ভালো হলে জন্ডিস ভালো হয়ে যাবে। আবার ধরুন লিভারে টিউমার বা ক্যান্সার হওয়ার কারণে পিত্তরস প্রবাহিত হতে না পেরে রক্তে মিশে রক্তের বর্ণ কি হলুদ করে দেয় এক্ষেত্রে এটাকে বলা হয় অবস্ট্রাক্টিভ জন্ডিস এক্ষেত্রে চিকিৎসা দিতে হবে টিউমার বা ক্যান্সারের।
উল্লেখিত আলোচনা থেকে আপনারা নিশ্চয়ই বুঝতে পারলেন যে রক্তে যদি বিলোরুবিনের মাত্রা বেড়ে যায় তখন আমরা তাকে জন্ডিস বলব। চিকিৎসার ক্ষেত্রে আমরা জন্ডিসের কারণটির চিকিৎসা করব তবে কখনোই জন্ডিসের চিকিৎসা করবো না। জন্ডিসের ক্ষেত্রে সব ধরনের চিকিৎসা কবিরাজি চিকিৎসা বা দোকান থেকে জন্ডিসের ফাইল কিনে সেবন করা কতটা বিপজ্জনক তার কিছুটা নিশ্চয়ই আপনারা বুঝতে পেরেছেন।
আমরা অনেকেই জানি আমাদের রক্তের লহিত কণিকা গুলোর গড় আয়ু ১২০ দিন। এরপর লোহিত কণিকা গুলো স্বাভাবিক নিয়মে ভেঙে গিয়ে বিলোরুবিনে পরিবর্তিত হয় এরপরে লিভার এটিকে প্রক্রিয়াজাত করে ব্যবহার উপযোগী করে।
বিলোরুবিন দুই প্রকার:
- আনকন্জুগেটেড বা ইনডাইরেক্ট বিলোরুবিন,
- কন্জুগেটেড বা ডাইরেক্ট বিলোরুবিন,
আনকন্জুগেটেড বা ইনডাইরেক্ট বিলোরুবিন
লোহিত রক্ত কণিকা ভেঙে গিয়ে স্বাভাবিকভাবে বিলোরুবিনে রূপান্তরিত হয় এবং তা অ্যালমুবিনের সাথে যুক্ত হয়ে কিছু সময় রক্তরসে থাকে। এই অবস্থায় বিলোরুবিন বিষাক্ত বা ক্ষতিকর এই অবস্থায় বিলোরুবিনকে ইনডাইরেক্ট বিলোরুবিন বলা হয়। এটি পানিতে অদ্রবণীয় ফলে প্রসাবের সাথে নির্গত হতে পারে না।
কন্জুগেটেড বা ডাইরেক্ট বিলোরুবিন
ইনডাইরেক্ট বিলোরুবেন লিভারে আসার পর লিভারের কোষ গুলোকে পরিশোধন করে ডাইরেক্ট বিলোরুবিনে পরিবর্তিন করে এটি বিষাক্ত নয় এবং পানিতে দ্রবীভূত হতে পারে। সুস্থ মানুষের মধ্যে বিলুরোবিন পাওয়া যায় না। তবে যদি জন্ডিস জনিত কারণে মূত্রে বিলোরুবিন পাওয়া যায় তাহলে বুঝতে হবে এটি কন্জুগেটেড বিলোরুবিন কারণ, আনকন্জুকেটেড বিলুরোবিন পানিতে দ্রবণীয় নয়।
You may also likes
থ্যালাসেমিয়া নির্ণয়ের কয়েকটি পরীক্ষা (বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন)
গরমের কারণে স্টোক বিপদের চিহ্ন ও করণীয় (বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন)
চুল পড়া রোধে ঘরোয়া উপায় (বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন)
রোগ প্রতিরোধে কাঁচা হলুদ (বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন)
টয়লেট নরম করতে কিছু সমাধান (বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন)
জন্ডিস কত প্রকার
জন্ডিস প্রধানত তিন প্রকার।
- অবস্ট্রাক্টিভ বা অবরোধ জনিত জন্ডিস,
- হিমোলাইটিক বা রক্তকণিকা ধ্বংসজনিত জন্ডিস,
- টক্সিক ও ইনফেকটিভ বা হেপাটেসেলুলার জন্ডিস,
অবসট্রাক্টিভ বা অবরোধজনিত জন্ডিস
কোন কারণে পিত্ত লিভারের কোষ থেকে উৎপন্ন হয়ে পিত্ত নালীর মাধ্যমে ক্ষুদ্রান্তে বের হয়ে যাওয়ার পথে যদি বাঁধাপ্রাপ্ত হয় এবং পুনরায় রক্তে মিশে গিয়ে দেহের চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং দেহের ত্বক, চোখের শ্বেতমন্ডল ইত্যাদি হলুদ হয়ে যায় এটিকে অবস্ট্রাকটিভ বা অবরোধ জনিত জন্ডিস বলে।
অবসট্রাক্টিভ জন্ডিসের লক্ষণ
প্রথমে চোখের রঙ হলুদ হয়ে যায়। জন্ডিসের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার সাথে সাথে শরীরের বর্ণ হলুদ রঙ ধারণ করে। শরীরে চুলকানি থাকে, মল সাদা বর্ণের হয় এবং প্রসাব টকটকে হলুদ রঙের হয়। মাত্রা বেড়ে গেলে থুথু এবং শরীরের ঘামও হলুদ হয়ে যায়।
হিমুলাইটিক বা রক্তকণিকা ধ্বংসজনিত জন্ডিস
যদি কোন কারনে অতিরিক্ত রক্তকণিকা ভেঙে যায় ফলে রক্তে বিলোরুবিনের মাত্রা বেড়ে গিয়ে জন্ডিস দেখা দেয়। যেমন বিষাক্ত সাপের কামড়ের কারণে হিমলাইটিক জন্ডিস দেখা দেয়। কারণ সাপের বিষে হিমোলাইসিন নামক এক ধরনের টক্সিন থাকে যা লোহিত কণিকাকে ভেঙে ফেলে ফলে অতিরিক্ত বিলোরুবিন জমা হয়ে জন্ডিস দেখা দেয়।
হিমালাইটিক জন্ডিস চেনার উপায়
ত্বকের রঙ হালকা হলুদ বা লেবুর রঙের মত হয়, চোখ হলুদ হয় না। শরীরের চুলকানি থাকে না এবং মলের রং স্বাভাবিক থাকে। প্রসাবের রং স্বাভাবিক থাকে কিন্তু কিছুক্ষণ পর তা হলদে হয়ে যায়।
টক্সিক ও ইনফেক্টিভ জন্ডিস
যেকোন বিষাক্ত পদার্থ বা যেকোনো সংক্রামক জীবাণুর টক্সিন দ্বারা লিভারের কোষগুলো আক্রান্ত হয়ে রক্ত প্রবাহিত হলে বা গুরুতর কোন কারণে কোষগুলো নষ্ট হয়ে গেলে লিভারের কাজে বিঘ্ন ঘটে ফলে বিলোরুবিন লিভারের কোষগুলোতে সঠিকভাবে যেতে না পাড়ায় তা অধিক পরিমাণে রক্তে জমতে থাকে এবং জন্ডিসের লক্ষণ গুলি প্রকাশ পায় এটিকে ইনফেক্টিভ জন্ডিস বলে।
টক্সিক ও ইনফেক্টিভ জন্ডিস চেনার উপায়
টক হলুদ বর্ণের হয়। চোখ হলুদ হওয়ার আগে শরীরের রঙ হলুদ হয়। মলের রঙ স্বাভাবিক কিংবা বিবর্ণ দেখায় এবং প্রসাব হলদে হয়।
আমাদের দেশের মানুষের জন্ডিস হওয়ার শতকরা ৭০ ভাগ কারণ হচ্ছে হেপাটাইটিস। হেপাটাইটিস 'এ', 'বি', 'সি', 'ডি' এবং 'ই' ভাইরাসের সংক্রমণে যকৃতের প্রদাহ সৃষ্টি হওয়াকে বলা হয় ভাইরাল হেপাটাইটিস।
নবজাতকের জন্ডিস
জন্মের পর ৭০ থেকে ৮০ ভাগ নবজাতকের জন্ডিস হতে পারে। জন্ডিসে আক্রান্ত শিশু প্রায় ৫০ শতাংশের বেলায় একে বলে স্বাভাবিক জন্ডিস। শিশুর যকৃত পুরোপুরি কর্মক্ষম হয়ে উঠতে একটু দেরি হলে রক্তে বিলুরোবিনের মাত্রা বেড়ে গিয়ে জন্ডিস হয়। এ সময় কোনভাবেই নবজাতককে বুকের দুধ খাওয়ানো থেকে বিরত রাখা যাবে না।
স্বাভাবিক জন্ডিস সাত দিনের মধ্যে ভালো হবার কথা। তবে জন্মের ২৪ ঘন্টার মধ্যে জন্ডিস দেখা দিলে এবং তা ৭ থেকে ১০ দিনের মধ্যে না সারলেও শিশু খাওয়া বন্ধ করে দিলে বা কমিয়ে দিলে জ্বর বা সংক্রমণের লক্ষণ দেখা দিলে এবং বিলুরোবিনের মাত্রা বাড়তে থাকলে অবশ্যই একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
জন্ডিসের আক্রান্ত রোগীর খাবার
এ রোগের রোগীদের জন্য খাবারের ব্যাপারে তেমন কোনো বিধি নিষেধ নেই। তবে ভাইরাল হেপাটাইটিসের যকৃতের কার্যকারিতা কিছুটা হলেও ব্যাহত হয়। তাই যকৃত ও পিত্তথলির উপর চাপ সৃষ্টি হয় এমন খাবার এড়িয়ে চলা উচিত। চর্বিজাতীয় খাবার যেমন- ঘি, মাখন, গরুর মাংস, খাসির মাংস ইত্যাদি। জন্ডিসের রোগীর ক্যালোরির উৎস হিসেবে অতি সহজেই হজমযুক্ত খাবার খাওয়া উচিত।
প্রচলিত কিছু ভ্রান্ত ধারণা :-
- জন্ডিস হলে হলুদ দিয়ে রান্না করা খাবার খাওয়া যাবেনা ও হলুদ রঙের খাবার খাওয়া উচিত নয়। হলুদ বাহ হলুদ রঙের খাবারের সাথে বিলোরুবিনের কোন সম্পর্ক নেই। অনেকেই রোগীকে তরল খাবার খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন কারণ এতে প্রসাবের হলুদ ভাব কিছুটা কম দেখা যায়। কিন্তু তারা জানেন না এতে রক্তের বিলোরুবিনের মাত্রার কোন পরিবর্তনই হয় না। উপরন্তু, রোগীকে বারবার টয়লেটে যেতে হয় এতে করে রোগীর বিশ্রামের ব্যাঘাত ঘটে। আবার আখের রস এবং অন্যান্য ফলের রসের মধ্যে অ্যালকোহল থাকে যা একজন লিভারের রোগীর জন্য এড়িয়ে চলা উচিত।
জন্ডিস পরীক্ষা স্বাভাবিক রেঞ্জ
কন্জুগেটেড বা ডাইরেক্ট বিলোরুবিন প্রতি ডেসিলিটারে ০.৩ মি.গ্রা. এর নিচে থাকা স্বাভাবিক এর বেশি হলে জন্ডিস বলে বিবেচিত হবে।
টোটাল বিলোরুবিন বা দুই প্রকার বিলোরুবিনের যোগফল:- স্বাভাবিক রেঞ্জ প্রতি ডেসিলিটারে ০.১ থেকে ১.২ মিলিগ্রাম।
আজকের এই পোস্ট থেকে আপনারা গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য জানতে পেরেছেন। এই তথ্যমূলক টিপস্ সমূহ আপনাদের নিশ্চয়ই অনেক উপকারে আসবে।
Related search
চোখের এলার্জি ও চুলকানির সুরক্ষায় করণীয় (বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন)
দাঁতের মাড়ি ফোলার কারণ ও প্রতিকার (বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন)
টিউমার কি পাকস্থলী টিউমার হলে করণীয় (বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন)
হার্ট এটাকে করনীয় (বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন)
ব্রণের দাগ ও গর্ত দূর করতে ঘরোয়া এবং আধুনিক চিকিৎসা (বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন)
পাইলসের কার্যকারী ঘরোয়া সমাধান (বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন)
উচ্চ রক্তচাপ বেড়ে গেলে করণীয় (বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন)
দুশ্চিন্তা করলে কি কি সমস্যা হয় (বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন)
অল্প বয়সে চুল পড়ার কারণ ও প্রতিকার (বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন)
এলার্জির লক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণে রাখতে করণীয় (বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন)